তাওরাতের যুগে মানবসভ্যতা

(MANKIND IN THE OLD TESTAMENT)

ক) হাবিল ও কাবিলের গল্প

কিতাবুল মোকাদ্দসে লেখা আছে—-

পয়দায়েশ ৪:১ আদম তাঁর স্ত্রী হাওয়ার কাছে গেলে পর হাওয়া গর্ভবতী হলেন, আর কাবিল নামে তাঁর একটি ছেলে হল তখন হাওয়া বললেন, “মাবুদ আমাকে একটি পুরুষ সন্তান দিয়েছেনপরে তাঁর গর্ভে কাবিলের ভাই হাবিলের জন্ম হল হাবিল ভেড়ার পাল চরাত আর কাবিল জমি চাষ করত

পরে এক সময়ে কাবিল মাবুদের কাছে তার জমির ফসল এনে কোরবানী করল। হাবিলও তার পাল থেকে প্রথমে জন্মেছে এমন কয়েকটা ভেড়া এনে তার চর্বিযুক্ত অংশগুলো কোরবানী দিল। মাবুদ হাবিল তার কোরবানী কবুল করলেন, কিন্তু কাবিল তার কোরবানী কবুল করলেন না। এতে কাবিলের খুব রাগ হল আর সে মুখ কালো করে রইল। এই অবস্থা দেখে মাবুদ কাবিলকে বললেন, “কেন তুমি রাগ করেছ আর কেনই বা মুখ কালো করে আছ? যদি তুমি ভাল কাজ কর তাহলে কি তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না? কিন্তু যদি ভাল কাজ না কর তবে তো গুনাহ্তোমাকে পাবার জন্য তোমার দরজায় এসে বসে থাকবে; কিন্তু তাকে তোমার বশে আনতে হবে।এর পর একদিন মাঠে থাকবার সময় কাবিল তার ভাই হাবিলের সংগে কথা বলছিল, আর তখন সে হাবিলকে হামলা করে হত্যা করল

তখন মাবুদ কাবিলকে বললেন, “তোমার ভাই হাবিল কোথায়?”

কাবিল বলল, “আমি জানি না। আমার ভাইয়ের দেখাশোনার ভার কি আমার উপর?”

১০ তখন মাবুদ বললেন, “ তুমি কি করেছ? দেখ, জমি থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত আমার কাছে কাঁদছে। ১১ জমি যখন তোমার হাত থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত গ্রহণ করবার জন্য মুখ খুলেছে তখন জমির বদদোয়াই তোমার উপর পড়ল। ১২ তুমি যখন জমি চাষ করবে তখন তা আর তোমাকে তেমন ফসল দেবে না। তুমি পলাতক হয়ে দুনিয়াতে ঘুরে বেড়াবে।

ব্যাখ্যা

কিতাবের এই অংশ নিয়ে আমরা বিশেষ আলোচনা করবো। যে দুটি বিষয় আমাদের নিকট প্রকাশ করা হয়েছে তা হলঃ

  • পিতামাতার যে পাপ করার স্বভাব তা উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানদের মধ্যেও এসেছে। যে মন্দতার প্রতি তারা নিজেদেরকে উন্মোচিত করেছিল, তা তাদের সন্তানদের রক্তের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল। তাদের প্রথম সন্তান নিজের ছোট ভাইকে খুন করেছিল।
  • দ্বিতীয়ত, আমরা দেখতে পাই প্রত্যেক মানুষই বেছে নিতে পারে সে আল্লাহর অধীন হবেন কি হবেন না। আমরা এখানে দুটি ছেলের গল্প দেখি যেখানে তাদের একই মা-বাবা ছিল এবং একই ঘরে তারা বেড়ে উঠেছিল। হাবিল সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং মাবুদও তাকে গ্রহন করেছিলেন। মাবুদ তার কোরবাণী গ্রহন করে তাকে দেখিয়েছিলেন যে তিনি তাকে গ্রহন করেছিলেন। কাবিল একজন অহংকারী মানুষ ছিলেন এবং আল্লাহ তার সাথে কথা বলতেন তবুও তার মন ছিল কঠিন। তার নিজের সিদ্ধান্তেই, তার জীবন ধ্বংস হয়েছিল।

কিতাবুল মোকাদ্দসের প্রথম দিকে (তাওরাত এ) আমরা একই জিনিস বার বার দেখতে পাই- কিছু মানুষ আল্লাহকে প্রত্যাখান করছেন এবং নিজেদের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, অন্যদিকে বাকীরা আল্লাহকে নিজেদের জীবনে গ্রহন করছেন এবং তার রহমত লাভ করছেন। 

খ) সবচেয়ে বড় বন্যা

এরপরের যে ঘটনা আল্লাহর কালামে আমরা দেখতে পাই যে একটা ভারী বন্যা হয় যেখানে সবাই ডুবে মারা যায় তাদের পাপের জন্য, শুধু আটজন মানুষ মারা যান না। আল্লাহ সেই আটজনকে বাচিয়েছিলেন, তারা হলেন নোহ্‌ ও তার পরিবার, যারা বন্যার সময় কাঠের জাহাজে ছিলেন যা তারা নিজেরাই বানিয়েছিলেন বন্যা শুরু হওয়ার আগে (পয়দায়েশ ৬-৯)। 

গ) বাবিলের উচু দালান  

 এরপর যে ঘটনা আমরা দেখতে পাই তা হলো বাবিলে উচু দালান নির্মাণের যেখানে সব মানব জনতা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল সেই দালান নির্মাণ করতে চেয়ে যা তারা ঠিক করেছিল বেহেস্ত পর্যন্ত উচু হবে (পয়দায়েশ ১১)।

 তারা এই দালান বানাতে চাইছিল কারণ তাদের অহংকার ছিল। তারা শ্রেষ্ঠ হতে চেয়েছিল এবং তাদের পরবর্তী উত্তরসূরীরা যেন সেই দালান দেখে তাদের নামের জয়ধ্বনি করে। এটাও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল কারণ আল্লাহ তাদেরকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে ও বংশবৃদ্ধি করতে হুকুম করেছিলেন।

আল্লাহ তাদের মধ্যে অনেক ভাষা দিয়ে দিলেন এবং তখন কেউ কাউকে বুঝতে পারছিল না এবং যোগাযোগ করতে পারছিল না তাই তারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। তারা প্রচন্ড লজ্জিত হয়েছিল কারণ তাদের সব উত্তরসূরীরা যখন অসমাপ্ত দালান দেখবে তখন তারা বলবে যে আমাদের পুর্বপুরুষ ব্যার্থ ছিলেন যারা এই দালানের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।

গুনাহ্‌ সবসময় পরিশেষে গুনাহগারকে লজ্জা ফেলে। একজন অতি ধনী ব্যাক্তির দুর্নীতি যখন ধরা পড়ে, তখন তাকে জেলে পাঠানো হয় এবং সে ও তার পরিবার তখন চরম লজ্জায় পড়ে।

এখানে লক্ষ্য করে দেখুন কত সহজে কোন রক্তপাত ছাড়াই আল্লাহ তাদের বিদ্রোহ থামিয়েছিলেন। যখন আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় হয় তখন আমাদের যে হিংস্রতার পথ অবলম্বন যে করতেই হবে তা কিন্তু নয়। যদি আমরা আমাদের জীবন আল্লাহর ইচ্ছায় চালাই, তাহলে যদি আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে মুনাজাত করি তখন তিনিই সবকিছু ঠিক করবেন।

বাবিলের দালান নির্মাণের সময়ই ভিন্ন ভিন্ন জাতির সৃষ্টি হয়।

 ঘ) হযরত ইব্রাহিমকে আল্লাহ আহবান করলেন

 আমাদের আলোচ্য অংশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল হযরত ইব্রাহিমের গল্প। আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমকে বেছে নিলেন আল্লাহভক্ত একটি জাতির পিতা হবার জন্য যে জাতিকে তিনি নিজের লোক বলে ডাকবেন। এই জাতির মধ্য দিয়ে তিনি সমস্ত জাতিকে তিনি রহমত দান করবেন (পয়দায়েশ ১২)।

বস্তুতপক্ষেই ইব্রাহিম ছিলেন আল্লাহর বান্দা। খুব অল্প লোকই খুজে পাওয়া যাবে যারা হযরত ইব্রাহিমের মতো আল্লাহর উপর ঈমান এনেছেন। তিনি ২৫ বছর আল্লাহর কাছ থেকে পুত্র পাবার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, এবং পুত্রলাভের পর আল্লাহর আহবানে তিনি সেই পুত্রকে কোরবানি করতেও গিয়েছিলেন। সেটা তিনি করতে গিয়েছিলেন কারণ তিনি আল্লাহর ওয়াদার উপর ঈমান এনেছিলেন যে তার পুত্র ইসহাকের মধ্য দিয়ে তিনি এক মহাজাতির সৃষ্টি করবেন। তিনি পুরো হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করেছিলেন যে ইসহাককে তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত করবেন।

সত্যি বিষয় হলো এই উপায়ে আল্লাহ তার প্রতি ইব্রাহিমের মহব্বত, ঈমান ও বাধ্যতার পরীক্ষা করে দেখছিলেন। যেখানে আদম ও হাওয়া ফল নিয়ে যে পরীক্ষা ছিল তাতে ব্যার্থ হয়েছিলেন সেখানে ইব্রাহিম পুত্রকে নিয়ে কৃত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছিলেন। আল্লাহ দেখতে পেলেন যে ইব্রাহিম তার পুত্রকে কোরবানী দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাই যখনই ইব্রাহিম ইসহাককে তার ছুরি দিয়ে বধ করতে যাবেন ঠিক তখনি আল্লাহ তাকে থামিয়ে দিলেন এবং তাকে একটি মেষ দেখালেন এবং ইসহাকের পরিবর্তে সেই মেষ কে কোরবানি দিতে বললেন।

এই মেষই ছিল আল্লাহর একমাত্র পুত্র, ঈসা মসীহের চিত্র, যাকে ২০০০ বছরেরও অধিক সময়ের পরে সলিবের উপর কোরবানি করা হয়। সলিবের উপর সেই রক্তদানের মধ্য দিয়ে অনেক অনেক মানুষ নাজাত পেল, আল্লাহর সন্তান হলো এবং একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিনত হলো, ঠিক যে ওয়াদা আল্লাহ ইব্রাহিমকে করেছিলেন।

ইব্রাহিমের উত্তরসুরীরা সংখ্যায় বৃদ্ধিলাভ করলো এবং নিজের দেশ সহ একটি মহাজাতিতে পরিনত হলো, কিন্তু আস্তে আস্তে তারা আল্লাহর পথ থেকে সরে গেল এবং বার বার তার জন্য কঠিন তাড়না ভোগ করতে লাগলো। 

তবুও সেই জাতি বনি-ইসরাইল থেকে সবচেয়ে ভাল যা হলো, ইব্রাহিমের জন্মের ২০০০ বছরেরও পরে আল্লাহর পুত্র বেহেস্ত থেকে আসলেন তার নিজের জীবন আমাদের গুনাহের মূল্য হিসেবে দিতে, এবং যিনি নারী থেকে জন্মলাভ করবেন ও ইব্রাহীমের একজন বংশধর হবেন।

এই সকল বিষয় নিয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো।

//////////